জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য, 'অরাজনৈতিক' এবং সম্পূর্ণভাবে তরুণ-শিক্ষার্থী-নির্ভর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের পূর্বপরিকল্পনা থেকে নয়, বরং সমাজের গভীরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সৃষ্টি হয়। জুন মাস থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনটি হাইকোর্টের একটি আদেশ ঘিরে নতুন প্রাণ পায়, যখন আদালত কোটাব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে। সেই আইনি ভিত্তি থেকে সৃষ্ট স্রোতধারাটি খুব দ্রুত দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে এটি "জুলাই বিপ্লব" নামে পরিচিতি লাভ করে।
এই অভ্যুত্থানের কর্মসূচি আয়োজনে ছাত্ররাই ছিল মূল নেতৃত্বে। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল গৌণ কিংবা অনানুষ্ঠানিক অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ। শুরুতে শুধুমাত্র শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হলেও, আন্দোলনের তীব্রতা খুব দ্রুত সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষ, নারী ও সংখ্যালঘুরাও এতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রদের মেধা, তরুণদের সাহস এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ এই আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল সেই ছাত্ররা, যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমে এসেছিল। পুলিশের টিয়ারশেল, রাবার বুলেট এবং সরকারি বাহিনীর নৃশংস হামলায় শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়। কিন্তু এই বর্বর আক্রমণ তাদের দমাতে পারেনি। বরং, তারা নিজেদের উদ্যোগে রাস্তায় ফার্স্ট এইড ক্যাম্প তৈরি করে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং একে অপরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই মানবিক শৃঙ্খলা ও ঐক্য ছিল আন্দোলনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা আন্দোলনকারীদের নৈতিক ভিত্তিকে আরও মজবুত করেছিল।
এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও মর্মস্পর্শী অংশ হলো তীব্র দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড, যা 'জুলাই গণহত্যা' নামেও পরিচিত। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ এবং সরকারি বাহিনীগুলো ছাত্র-জনতাকে দমনে গুপ্ত ও প্রকাশ্য ভূমিকা পালন করে। নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাব অনুযায়ী শতাধিক হলেও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সূত্রে এই সংখ্যা ১,০০০ থেকে ১,৫৮১ পর্যন্ত অনুমান করা হয়। এই নৃশংসতা আওয়ামী সরকারের দীর্ঘদিনের দুঃশাসন, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়।
এই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যখন সাধারণ মানুষ একাত্ম হলো, তখন তা এক অপ্রতিরোধ্য গণজোয়ারে পরিণত হয়। শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচালক থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও গৃহিণীরাও এই বিপ্লবে অংশ নেন। তাঁরা কেবল মিছিলে যোগ দেননি, বরং মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আন্দোলনকারীদের জন্য খাবার ও পানি সরবরাহ করেছেন, তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন এবং পুলিশের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মানবঢাল তৈরি করেছেন। এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই প্রমাণ করে, একটি জাতি কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
জুলাই বিপ্লবে সমাজের পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের নীরব সমর্থন এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যখন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তখন চিকিৎসকরা গোপনে আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা দিয়েছেন এবং তাদের পরিচয় গোপন রেখেছেন। আইনজীবীরা এগিয়ে এসেছেন গ্রেপ্তারকৃতদের আইনি সহায়তা দিতে, যা ছিল সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিরোধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং তাদের নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছেন। এই সম্মিলিত পেশাজীবী প্রতিরোধ সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিল।
এই গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেনি, বরং এটি দেশের অর্থনীতিতেও সরাসরি আঘাত হেনেছিল, যা ছিল সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের এক নীরব প্রতিবাদ। আন্দোলনের কারণে দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে যায়, শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। সরকার তার লুটপাট ও লোক দেখানো মেগা প্রকল্পের নামে যে ভঙ্গুর অর্থনীতি তৈরি করেছিল, এই অবরোধ ও ধর্মঘট তা প্রকাশ করে দেয়। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অচল করে দিয়ে জনগণ বার্তা দেয় যে, তারা একটি দুর্নীতিবাজ সরকারের অধীনে আর কোনোভাবেই থাকতে রাজি নয়।
যখন মূলধারার গণমাধ্যমগুলো সরকারের কঠোর নজরদারি ও সেন্সরশিপের কারণে স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারছিল না, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে ওঠে জনগণের কণ্ঠস্বর। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো পরিণত হয় এক ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্রে। আন্দোলনকারীরা নিজেরাই সাংবাদিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, মুহূর্তের মধ্যে হামলা, গ্রেপ্তার ও নৃশংসতার ভিডিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।
এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন আন্দোলনের তথ্য ও চেতনা ছড়িয়েছে, তেমনি সরকারের মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গণহত্যার দৃশ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিবিসি ও আল-জাজিরা-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানায়। তাদের কঠোর প্রতিবেদনগুলো আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এবং রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করে, যা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
এই আন্দোলনটি শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়নি। এই ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কার, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার সুনির্দিষ্ট দাবি তোলে। তারা একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার সংস্কারমূলক আহ্বান করেছিল।
সবশেষ, গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট তীব্র চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন পথের ভিত্তি স্থাপন হয়।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি আন্দোলনই ছিল না, বরং এটি ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এটি ছিল এক নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সৃষ্ট জনগণের জাগরণ, যা প্রমাণ করেছে—যখন ছাত্র-জনতা এক হয়, তখন কোনো স্বৈরাচারী শক্তিই তাদের সামনে টিকতে পারে না। এই অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়, যা শুধুমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং জনগণের ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই গণঅভ্যুত্থান এক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সমতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
লেখক: খাব্বাব হোসেন ত্বহা, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক




Comments
Post a Comment